post
অনুষ্ঠান

তারা ভাসলো, সকলকে ভাসালো বাংলার আবেগে

মাহমুদ মেনন: তারা ভাসলো, জেগে উঠলো, জাগিয়ে তুললো সকলকে, বাংলার আবেগে। ছোট্ট শিশুটি যখন বললো, গাইলো-- কইতো যাহা আমার বাবায় কইতো যাহা আমার দাদায়, এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়। অপর শিশুটি যখন অনবদ্য অভিনয় করলো, 'মাগো ওরা বলে তোমার কথা কেড়ে নেবে, গল্প শুনতে দেবে না মা তোমার কোলে শুয়ে, সেই কবিতায়। কিংবা আরো যারা বড় তারা যখন গাইলো ভাই হারানোর ব্যাথার গান তখন কার বা জানতে বাকি থাকে- এরা বাঙালি, যারা আজ এই সন্ধ্যায় বাংলাদেশ থেকে ভূ-গোলকের ঠিক উল্টো দিকে অমর একুশের গান গাইছে, কবিতা পড়ছে। বুঝে নিতে হবে কেনো- সেইখানে ক্ষণে ক্ষণে তো বেজেই চলেছে হৃদয় নিংড়ানো সেই সুর- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।  তেমনই এক আবহ, তেমনই এক অনিন্দ্য উপস্থাপনায় অমর একুশে আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি, ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষেরা। তারা সেজেছিলেন একুশের সাজে সাদা-কালোয়া। তারা আবেগে ভেসেছিলেন। তারা মনের জোয়ারে নিয়ে এসেছিলেন বাংলা মায়ের বন্দনা। তারা প্রভাতফেরী করতে হয়তো পারেননি, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় ফুলের তোড়া সাজিয়ে নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনারে গেছেন। শ্রদ্ধার অঞ্জলি তারা তুলে দিয়েছেন শহীদের পদতলে, শহীদ মিনারের বেদীতে। শহীদ মিনার! এই সুদুর পরবাসে! হ্যা সত্যিই তাই। পরম আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে তারা বানিয়েছিলেন স্মৃতির মিনার। পেছনে রক্তঝড়া লাল সূর্য, সামনে নতমস্তক দাঁড়িয়ে থাকার সেই কাঠামো কার না ভালো লাগে। কে না এক নজর দেখতে চায়? বিশেষ করে এই দিনটি আসলে। তাই আয়োজকরা তৈরি করেছিলেন শহীদ মিনার। সে মিনার বয়ে এনে বসিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে স্থলে। ভার্জিনিয়ার আর্লিংটনে কেনমোর মিডল স্কুলের বিপুল মিলনায়তনের একপাশে বিপুলাকায় শহীদ মিনারটি তার সগৌরব অবস্থান নিয়েছিলো। আর মঞ্চ জুড়ে চলছিলো একুশের নানা আয়োজন। আয়োজক গ্রুপটি ডিসি একুশে অ্যালায়েন্স নামে সুপরিচিত। প্রায় তিন দশক ধরে তারা আয়োজন করছে এমন একুশের উদযাপন। তবে আয়োজকরাই বলছিলেন, এবারের উদযাপনটি তারা অনেক গুছিয়ে, প্রাণের মতো করে সাজিয়ে তবেই করতে পেরেছেন। সে কথার মিল খুঁজে পাওয়া গেছে আয়োজনেই। মূল আয়োজনটি শুরু হয় বিকেলে। এরপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ১০টা অবধি চলে। আয়োজনে ছিলো গান, কবিতা, নাচ, নাটিকা। সবগুলো উপস্থাপনাই ছিলো মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। তবে তারও চেয়ে বেশি বড় আকর্ষণের ছিলো ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন মাত্রার সব উপস্থাপনা। আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের এই আয়োজনকে আন্তর্জাতিকতা দিতে আয়োজকরা ডেকেছিলেন ভিন দেশি শিল্পী কুশলীদেরও। মেক্সিকান, মঙ্গোলীয় দুটি শিল্পী দলের অনবদ্য অনন্য উপস্থাপনাও উপভোগ করেছেন বাংলাদেশি আমেরিকানরা। এখানে এখন বাংলাদেশিদের কেউ কেউ চতূর্থ প্রজন্মেরও। কেউ দ্বিতীয় কেউ তৃতীয়। শিশু-কিশোর কিশোরীদের অনেকেরই জন্ম এদেশে। এদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিই তাদের নিত্য চর্চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়নি বাংলার সংস্কৃতি। ধন্য সেই সব বাবা-মায়েদের যারা নিজের সংস্কৃতিবোধকে তাদের সন্তানদের মধ্যে দারুণ উপলব্দিতে সঞ্চারিত করতে পেরছেন। তাই ছোট্র শিশুটি যখন বলে ওঠে, এতো আমার প্রাণের বাংলা, তখন বুক ভরে ওঠে। অনুষ্ঠানে ছিলো অনেক কিছু। বেশ বড়সড় একটি ডালি সাজিয়ে বসেছিলেন শিল্পী-কলাকুশলীরা। তবে তার আগে জানিয়ে রাখি এই অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে বাংলাভাষার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছেন ভার্জিনিয়া হাউজ অব ডেলিগেট আলফন্সো এইচ লোপেজ, আর্লিংটন কাউন্টি বোর্ডের চেয়ার কেটি ক্রিস্টল, সেনেটর মার্ক ওয়ার্নারের কার্যালয়ের প্রতিনিধি অ্যান ফন ও আর্লিংটন আর্টস কমিশনের চেয়ার অনিকা কিনানা। প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম, ছিলেন ভার্জিনিয়াস্থ আইগ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বাংলাদেশি আমেরিকান আবুবকর হানিফ। তার প্রতিষ্ঠিত অপর প্রতিষ্ঠান পিপলএনটেক ছিলো আয়োজনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে, আর অপর প্রতিষ্ঠান এনআরবিসি টেলিভিশন ছিলো মিডিয়া পার্টনার। অনুষ্ঠানস্থলে যারা যখনই উপস্থিত হয়েছেন তাদের সকলের মুখেই প্রশংসা পেয়েছে মঞ্চের এক দিকে স্থাপিত শহীদ মিনার। সাদাটে ফ্রেমের পেছনে লাল সূর্য আর সামনে সাদা কাপড় দিয়ে তৈরি বেদী। তাতেই সকলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তবে এই অংশটি ছিলো অনুষ্ঠান আয়োজনের সব শেষে।জানিয়ে রাখি, যুক্তরাষ্ট্রে একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের মতো ছুটি থাকে না, ফলে এখানের কোনো আয়োজন করতে হলে সপ্তাহান্ত বেছে ছুটির দিনগুলোতেই করতে হয়। আর সে কারণেই আয়োজনটি করা হয় রবিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি)। তবে পুরো আয়োজনেই ছিলো একুশে উদযাপনের সব আবহ। শুরু যখন হলো জাতীয় সঙ্গীতে ততক্ষণে হল কানায় কানায় পূর্ণ। তাদের সামনে পরপরই উপস্থাপিত হলো দলীয় গান ও নৃত্য- ২১ শুধু একটি সংখ্যা নয়, একটি মুক্তির মূলমন্ত্র। হিরণ চৌধুরীর পরিকল্পনা ও আবু রুমীর সহযোগিতায় এই উপস্থাপনায় সঙ্গীতের রচয়িতা ছিলেন অদিতি সাদিয়া রহমান, সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তাসলিম হাসান আর ধারা বর্ণনায় ছিলেন খায়রুজ্জামান লিটন। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন- আনিকা মেধা, মাসুমা আক্তার, স্যাম রিয়া, সারা লুদমিলা, শামীম সেলিমুদ্দীন, ইলা সোয়েব, মহসিনা রিমি, দোলা হোসেন, ক্লেমেন্ট গোমেজ স্বপন, শারাফাত হোসেন বাবু, হাসান চৌধুরী, মিজানুর ভূঁইয়া, সোয়েব রহমান, হাসনাত সানী। তবলায় ছিলেন পল ফেবিয়ান গোমেজ, একর্ডিয়ান-আবু রুমী, মন্দিরা বাজিয়েছিলেন প্রিয়লাল কর্মকার, কিবোর্ড বাজান হীরণ চৌধুরী, গিটারে ছিলেন শুভ্র। পুরো আয়োজনটির কোরিওগ্রাফার ছিলেন সঞ্জয় গোস্বামী। তার সঙ্গে নেচেছেন আদিবা রুপন্তি, সামাইলা মাহমুদ, মেহেক আজাদ, রুম্পা বড়ুয়া। আর উপস্থাপনায় ছিলেন ফয়সল কাদের, ফারহানা লিনা ও আতিয়া মাহজাবিন। এর পরপরই একুশের কবিতা পড়েন মিজানুর ভূঁইয়া- মায়ের শাড়ি ও বর্ণমালা এই শিরোনামে। কবিতার রেশ ফুরোতে ফুরোতেই ছোট্টদের একট নাচ হয়ে গেলো-আমার মুখের ভাষা- এই নামে। যার পরিচালক ও কোরিওগ্রাফার শিল্পী রোজারিও। আর নাচের পরিবেশনায় ছিলো পিটার পালমা, মনিষা গোমেজ, রিতি রোজারিও, স্যান্ড্রা পেরেরা ও এলিজাবেথ পালমা। ভাষা দিবসের ইতিকথা নিয়ে পুঁথি পাঠ করে শোনালেন জাফর রহমান। তার সঙ্গে যোগ দেন আবু রুমি, প্রিয়লাল, সুকুমার পিউরিফিকেশন, তিলক কর, হাসনাত সানী, আবু সরকার, সারা লুদমিলা, আনিকা মেধা, ইলা সোয়েবরা। ততক্ষণে রাত গড়িয়ে আসে। মাঝে অতিথিরা বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, প্রধান অতিথি এম শহীদুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, এই আয়োজন তাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি আপ্লুত। ভাষা সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের মাঝে আরও ছড়িয়ে দিতে আরও সঞ্চারিত করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানালেন তিনি। বললেন, দিবসটি আর কেবলই বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে আরও আন্তর্জাতিকতা দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন রাষ্ট্রদূত।কেটি ক্রিস্টল ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রশংসা করলেন এবং এমন একটি আয়োজনে অংশ নিতে পেরে যে আনন্দিত হয়েছেন তা জানালেন। আবু বকর হানিপ বললেন, আমরা প্রবাসে দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছি, কিন্তু আমাদের প্রাণের মাঝে স্থান করে রেখেছে বাংলা, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার প্রতি আমাদের ভালোবাসা। ভবিষ্যতে একুশে অ্যালায়েন্স আরো জমজমাট আয়োজন করবে এবং তিনি তার প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠান নিয়ে তার পাশে থাকবেন এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন আইগ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চ্যান্সেলর। একুশে অ্যালায়েন্সের এবারের আয়োজনের মূল সমন্বয়কারী সামছুদ্দীন মাহমুদ সকলকে এই আয়োজনে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দীর্ঘ চারমাস ধরে পরিশ্রমের এই ফসল। এই প্রজন্মের শিশু-কিশোররা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে, ভিন দেশীয়রা তাদের সংস্কৃতি নিয়ে এসে পরিবেশন করছে নাচ গান এটাই অনেক আনন্দের, বললেন তিনি। আয়োজনে আরও ছিলো ভাষা শহীদ ও বর্তমান প্রজন্মের বর্ণমালার সেতুবন্ধনে-বর্ণমালার প্রজন্ম শিরোনামে অনন্য এক আয়োজন। যার রচনা ও পরিচালনায় ছিলেন শম্পা বনিক। সঙ্গীত পরিচালনা করেন মিলি গোমেজ। বর্ণনায় ছিলেন তারিফ আর গান গেয়েছে জিনা, শৌমিক, অপসরা, মিলি, নেচেছে সিন্থিয়া, স্বাগতা, সিমি, অভিনয় করেছে ঐশ্বর্য নাইফা ও তীলক। এই আয়োজনে তবলায় ছিলেন পল গোমেজ, গিটার বাজিয়েছেন শুভ্র। বহুসংস্কৃতির উপস্থাপনা ছিলো এবারের আয়োজনে। তাতে অংশ নেয় মঙ্গোলীয় নাচের দলা খুরি তসম। নৃত্য পরিচালক গাননা গানখুইয়াক নাতসাগ এর সঙ্গে নাচে অংশ নেয় মুনখাবিয়ার দাসজেভেগ, গানসুখ নাতসাগ ও গানবাত ওয়ুনবাত। লস কোয়েজালেজ মেক্সিকান ডান্স এসেম্বেল দলের নেতৃত্বে ছিলেন লরা ক্রিটস। তার পরিচালনায় অনন্য সঙ্গীত ও বাজনার তালে তালে নাচ করেছেন জেমস কাস্টিলো, ফ্রান্সিসকো হোবজা, সিসি মাসলাঙ্কা, অ্যাসলে কাস্টিলো, গ্রেট, জেসিকা মিরান্ডা, সিয়েরা উলার্ড ও পলিনা গার্সিয়া। সব হয়েও তখনো যেনো কিছুই হয়নি। কারণ তখনও শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া বাকি। সে কারণে হল তখনও কানায় কানায় পূর্ণ। রাত তখন প্রায় ১০টা। যে ২৩ টি সংগঠন তাদের সকলের প্রতিনিধিরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এরপর বেজে উঠলো সেই প্রিয় গান। সকলে একসঙ্গে গেয়ে উঠলেন- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। খালি পায়ে তারা হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। একে একে ফুলে ফুলে ভরে উঠলো শহীদ মিনারের বেদী। 

About Us

NRBC is an open news and tele video entertainment platform for non-residential Bengali network across the globe with no-business vision just to deliver news to the Bengali community.