নিউজার্সিতে নজরুলময় দুই দিন, শতদল'র আয়োজনে সম্পন্ন নর্থ আমেরিকা নজরুল সম্মেলন
দিন দুটি হয়েছিলো নজরুলময়। নজরুলের গান, নজরুলের কবিতা, গান-কবিতায় নাচ আর নজরুলের নাটক এইসবে ভরে থাকলো সারাটিক্ষণ। ১৩ ও ১৪ আগস্ট- দুপুর থেকে রাত অবধি। এটি ছিলো নজরুল সম্মেলন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি কমিউনিটির সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের বিদগ্ধ জনেরা জমায়েত হলেছিলেন গার্ডেন স্টেট খ্যাত নিউ জার্সির ইস্ট বার্নসউইকের জেএমপি আর্টস সেন্টারে। এটি ছিলো ১৯তম নর্থ আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স। ১৩ আগস্ট দুপুর নাগাদ দর্শকরা জমায়েত হতে শুরু করেন কর্মসূচিতে। তাদের প্রায় সকলেরই ছিলো বাঙালি সাজ-পোশাক। অনুষ্ঠানস্থল সাজানো হয়েছিলো নজরুলের ছবি সম্বলিত ব্যানার পোস্টারে। আর মঞ্চে চলছিলো... গান- নাচ- কবিতার আসর। শুরুতেই সকলের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে গেলে খিলখিল কাজী, কবি নজরুলের নাতনি। তিনি এই আয়োজনকে উল্লেখ করলেন নজরুলকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সিঁড়ি হিসেবে। আর বললেন, নজরুল তার গান কাব্যে মানুষকেই সবচেয়ে বড় করে দেখেছেন।আয়োজন শুরুতেই জমে ওঠে জার্সি ওয়েভের পরিবেশনায়। নিউ জার্সির সুপরিচিত এই ব্যান্ডসঙ্গীতের শিল্পীরা গাইলেন নজরুলের গান- দুর্গম গিরি-কান্তর-মরু দুস্তর পারাবার ও শুকনো পাতার নুপুর পায়ে...। অনুষ্ঠানটি সাজানো হয় নানা ঢঙে... তারই অংশ হিসাবে পরিবেশিত হলো "নানা রঙে নজরুল"। পরিবেশনায় ছিলো বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ জার্সি। গুলশান জাহান রিক্তার গাওয়া অগ্নিবীণার ফুল দিয়ে... তুমি হাত খানি যবে রাখো মোর হাতেরও পরে কিংবা আজি মধুরও বাশরি বাজে-র পর সৃজনও ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ- গানে আমান্ডা আমানুল্লাহর নাচ দেখলো সকলে। শ্রীরূপা ঘোষালের খেলিছো এই বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু.... কিংবা সই ভালো করে বিনুনী বাঁধিয়া দে এইসবে গোটা মঞ্চ তথা চারিপাশ ততক্ষণে নজরুল আবহে। এমনই সময় বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে মঞ্চে এলো একটি দল। আবৃতির সাথে সাথে নাচ করে দেখালো শিশুরা। তার মধ্য দিয়ে শেষ হয় "নানা রঙে নজরুল"।এরপরপরই শুরু হয় সৃষ্টি অ্যাকাডেমির পরিবেশনায় "বর্ণিল নজরুল"। তাতেও ছিল গান আর নাচ। আলগা করো গো খোপার বাঁধন... কিংবা ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তোলে...এইসব গানে একের পর এক নাচের পালা চললো।রাঙামাটির পথে লো মাদল বাজে বাজের বাশের বাঁশি এই গানে পাহাড়ি সাজে সেজে ঘুঙুর পায়ে নেচে মঞ্চ মাতালো শিশু শিল্পীরা। এইসব নাচ গানের পারফরম্যান্স করে যাচ্ছিলো যারা, তারা সকলেই যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা। যারা চেতনায় ধারণ করে বাংলার সংস্কৃতি। শামুসুন্নাহার নিম্মি আর সাদিয়া খন্দকারের উপস্থাপনায় এগিয়ে চলছিলো অনুষ্ঠান মালা। তাতে প্রথম দিনের আরও পরের দিকে মঞ্চে নাচ-গান আবৃত্তির পরিবেশনা নিয়ে এলো শতদল। এই শতদলই ছিলো এবারের নজরুল সম্মেলনের প্রধান আয়োজক। তাদের উপস্থাপনা "চেতনায় নজরুল"- এ গাইলেন ওস্তাদ সালাহউদ্দিন আহমেদ- অঞ্জলি লহ সঙ্গীতে। পাঠ হলো বিদ্রোহী কবিতা। বলবীর চির উন্নত মম শির। আরো পরিবেশিত হলো- একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী... নমো নমো নমো বাংলাদেশ মমো।লাল-সাদায় সেজে মেয়েরা নাচলো জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখায়। নিল-সাদায় সেজে মেয়েরা নাচলো মেঘেরও ডমরু ঘন বাজে। হলো কবিতা পাঠ- তোমারে পড়েছে মনে। আর পাঠ হলো কবি নজরুলের সেই কালজয়ী বক্তৃতা... যদি আর বাঁশি না বাজে।"যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শুন্য থেকে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল....এই আয়োজনের শেষভাগে পরিবেশিত হলো কারার ওই লৌহ কপাটে একক নৃত্য। এইভাবে নাচে গানে কবিতায় ভরপুর করে তুলে মঞ্চে শুরু হলো উদ্বোধনীর আনুষ্ঠানিকতা। ততক্ষণে নজরুল আবহে দর্শক শ্রোতা মুগ্ধ। আয়োজনের মূল সমন্বয়ক কবির কিরণ অতিথিদের নিয়ে উঠলেন মঞ্চে। মঞ্চে ছিলেন মাহমুদ মোশাররফ হোসেন, ড. জিয়া উদ্দিন, ইঞ্জি. আবুবকর হানিপ, আজিজ আহমদ, সুলতান আহমেদ, রায়হানুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম ফারুক ভূঁইয়া, খিলখিল কাজী, রাহাত চৌধুরী, অ্যান্থনী পিযুষ, সালাহউদ্দিন আহমেদ,সুজিত মুস্তফা, লিনা তাপসী, গুলশান আরা কাজিসহ আরও অনেকে। মাহমুদ মোশাররফ হোসেন এবারের আয়োজনের পাশাপাশি নজরুল সম্মেলনের গোড়ার দিকের কথা তুলে ধরেন। এই আয়োজনের অন্যতম দুই পৃষ্ঠপোষক রায়হানুল ইসলাম চৌধুরী ও ইঞ্জি. আবুবকর হানিপ এতে বক্তব্য রাখেন। রায়হানুল তার বক্তব্যে তুলে ধরেন কবি নজরুল আজ থেকে ১০০ বছর আগে যে বক্তব্য রেখে গিয়েছিলেন তা পরিবেশ আন্দোলনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আবুবকর হানিপ জোর দেন শিক্ষার ওপর। তিনি এই প্রবাসে নজরুলের চেতনা ধারণ করে নতুন প্রজন্ম যেভাবে তাদের গড়ে তুলছে তার প্রশংসা করেন। নিজের পরিচালিত ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কথা- তুলে ধরে তিনি বলেন, এই দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে এখানকার ডিগ্রি অর্জন জরুরি। আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই নিজ নিজ সংস্কৃতির চর্চায় জোর দেওয়া সম্ভব। এই আয়োজনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলো ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। একজন বাংলাদেশ আমেরিকান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে তা পরিচালনা করছেন এমন একটি বিষয় সকলকে মুগ্ধ করে। দর্শকরা করতালির মাধ্যমে আবুবকর হানিপকে অভিনন্দন জানান। এরপর আবার গান। সুদুর অস্ট্রেলিয়া থেকে গাইতে এসেছিলেন আদিলা নুর। যেনো সুরের লহরী তুললেন তার একের পর এক তিনটি উপস্থাপনায়- সুরেরও বাণি মালা দিয়ে তুমি আমায় ছুঁইয়া ছিলে। আরও গাইলেন- স্বপ্নে দেখি একটি নুতন ঘর। তুমি আমি দুজন প্রিয় তুমি আমি দুজন। আদিলা নুরের শেষ উপস্থাপনা ছিলো পদ্মার ঢেউ রে.... । পৃথিবীর উল্টো পীঠে বসে দর্শক যেনো সত্যিই শুনতে পেলো পদ্মার কুলুকুলু ঢেউয়ের শব্দ তার সুরের লহরীতে। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় সামিয়া মাহবুবের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই শিক্ষার্থী শোনালেন গান- অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে... আর চাঁদ হেরিছে চাঁদ মুখ তার। দর্শক শ্রোতারা সে গানের সুর কানে নিয়ে, চেতনায় নজরুলকে ধারণ করে রাতে ঘরে ফেরেন...।পরের দিন আবার আসেন তারা। নজরুলের টানে। দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় নজরুল বিষয়ক সেমিনার। আর বিকেলে গান-কবিতা-নাচের আসর। দ্বিতীয় দিনটিকে মাতিয়ে রাখে বিপা- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস। নিউইয়র্কভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি এদেশে নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির চেতনা। বিপার উপস্থাপনায় অনন্যভাবে পরিবেশিত হলো- বিদ্রোহী কবিতা। বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে অসাধারণ আবৃতির সাথে বিপা'র শিল্পীদের নাচ। সে পরিবেশনায় মুহুর্মূহু করতালি আর ছিলো দর্শকের মুগ্ধতা। দিনের পরের ভাগে গাইলেন সুজিত মুস্তাফা। ঢাকা থেকে এই নজরুল সম্মেলনে অংশ নিতেই যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন এই গুণি শিল্পী। আর আসর শেষ হয় ওস্তাদ সালাহউদ্দিনের গান দিয়ে। কবি নজরুলের প্রয়ান দিবস সামনে রেখে তিনি গাইলেন- সে চলে গেছে দূরে...নজরুল দূরে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন চেতনা। সেই চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি তাকে আজও স্মরণ করে। বাংলাদেশ থেকে সুদুর আমেরিকায় এসেও বাঙালি সেই চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ। তারই এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকলো এই ১৯ তম নর্থ আমেরিকা নজরুল সম্মেলন।